বাংলা রচনা

রচনাঃ চরিত্র

Rate this post

সূচনা 

মানুষের জীবনের সবচেয়ে দামি জিনিস হলাে চরিত্র। চরিত্র মানুষকে মানুষের কাছে ভালাে বা  খারাপভাবে উপস্থাপন করে। চরিত্র ভালাে হলে মানুষ ভালাে জানে। আর চরিত্র খারাপ হলে মানুষ খারাপ বলে। একজন মানুষের চরিত্র তার জীবনের সবকিছুকে প্রতিফলিত করে এবং সবকিছুর আয়নাস্বরূপ। চরিত্র ঠিক তাে জীবনের সব ঠিক এ কথা সবাইকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে।

চরিত্র কী

চরিত্র শব্দটি ইংরেজি ‘Character’ শব্দের প্রতিশব্দ হলেও মূলত তা এসেছে গ্রিক থেকে। আদিতে এর অর্থ ‘চিহ্ন’ হলেও প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে থেকে শব্দটি ব্যক্তির আচরণ ও আদর্শের উৎকর্ষবাচক গুণ বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। একজন মানুষের আচরণ ও আদর্শগত বৈশিষ্ট্যকে চরিত্র বলে। মানুষের চরিত্রের দুটি বিপরীত বৈশিষ্ট্য রয়েছে কেউ সচ্চরিত্র, কেউ দুশ্চরিত্র। যে মানুষের চরিত্র নানা মহৎ ও সৎগুণের আধার, তিনি সচ্চরিত্র। আর কারও চরিত্র লুকানাে পশুত্বের আধার হলে সেই চরিত্রই দুশ্চরিত্র। সচ্চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি সমাজের শ্রেষ্ঠ অলংকার। চরিত্রকে জীবনের মুকুট বলা হয়। মুকুট যেমন সম্রাটের শােভা বর্ধন করে, তেমনি চরিত্রও মানবজীবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। সততা, নীতিনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, সহৃদয়তা, সংবেদনশীলতা, ক্ষমা, উদারতা, ধৈর্য, কর্তব্যপরায়ণতা, গুরুজনে ভক্তি, মানবিকতা, আত্মসংযম ইত্যাদি সচ্চরিত্রের লক্ষণ। যিনি চরিত্রবান তিনি কখনাে ন্যায়-নীতি, আদর্শ ও সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হন না, দুর্নীতি ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না। তিনি সযত্নে ক্রোধ, অহংকার, রূঢ়তা ইত্যাদিকে পরিহার করেন। তিনি হন সত্যবাদী, সংযমী ও ন্যায়পরায়ণ। যাবতীয় মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে বলে চরিত্রবান মানুষ জাতির সম্পদ।

চরিত্র-গঠনমূলক শিক্ষার লক্ষ্য

চরিত্র গঠনই হলাে জ্ঞানার্জনের প্রধান লক্ষ্য। তাই ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলী বিকাশের লক্ষ্যে নিন্মলিখিত  দিকগুলাে শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাওয়া প্রয়ােজন ।

  • দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবপ্রেম ইত্যাদি সংগঠিত ভাবাবেশের পরিচর্যা। 
  • হিংসা, বিদ্বেষ, কুটিলতা ইত্যাদি মন্দ প্রবৃত্তি দমন। 
  • বিচার, সম্প্রীতি-চেতনা, মানবকল্যাণ ইত্যাদি মানবিক গুণাবলিকে জীবনের চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রহণ করা। 
  • নয়-নীতি, ধৈর্য, সাহস, সততা, সৌজন্য, কৃতজ্ঞতাবোধ ইত্যাদি সৎ ও মহৎ গুণাবলির বিকাশ ও লালন।
  • শৃঙ্খলা , সময়ানুবর্তিতা, শিষ্টাচার ইত্যাদি আচার-আচরণ-অভ্যাস গঠন। 

চরিত্র গঠনে বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীর ভূমিকা ছাড়াও বয় স্কাউট, গার্লস গাইড, রেডক্রস ইত্যাদি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা গুরুত্বপূর্ণ ।স্বেচ্ছা সংগঠনের মাধ্যমে মানুষ যৌথ কাজের গুরুত্ব ও আনন্দ অনুভব করতে পারে।

চরিত্র গঠনের গুরুত্ব 

মানুষের জীবনে চরিত্রের মূল্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। কেবল চরিত্রের শক্তিতে মানুষ হয়ে উঠতে পারে বিশ্ববরেণ্য ও চিরস্মরণীয়। কেবল চরিত্রের গুণে মানুষ অমর হতে পারে। মানবজীবনে চরিত্রের মহিমা সম্পর্কে ধারণা করা যায় একটি ইংরেজি সুভাষণ থেকে:
When money is lost nothing is lost, 
When health is lost something is lost, 
When character is lost everything is lost.
অর্থাৎ- টাকা হারালে কোনাে ক্ষতি নেই। স্বাস্থ্য হারালে কিছুটা ক্ষতি হয় |
কিন্ত‌ু চরিত্র হারালে সবকিছুই হারায়।
এজন্য চরিত্রের বিকাশ সাধনই মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত। মানুষ হয়ে জন্মালেই প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। প্রকৃত মানুষ হতে চাই উত্তম চরিত্র। কারণ কেবল মাত্র চরিত্রের মাধ্যমেই মানুষ  আর পশুতে পার্থক্য মেলে। এই জন্যেই বলা হয়ে থাকে চরিত্রহীন মানুষ পশুর সমান।
প্রবাদ আছে-
দুর্জন বিদ্যান হলেও পরিত্যাজ্য।’
কারণ, বিদ্যান লোক দুর্জন হলে তা সমাজের কল্যাণ না হয়ে অকল্যাণই হয় বেশি। এ প্রসঙ্গে একটি সুভাষিত স্মরণীয় উক্তি :
‘অমরত্বের সুধা পান না করেও মানুষ অমর হতে পারে কেবল চরিত্রের গুণে।

তাই চরিত্রের বিকাশ সাধনই মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত। পৃথিবীতে নিজেকে খাঁটি ও উন্নত করে গড়ে তোলাই মানুষের কাম্য। চরিত্রের মাধ্যমে মানুষের জীবন পদ্ধতিই কেবল নির্ধারিত হয় না, চরিত্রই এক অর্থে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে।

শিক্ষার মাধ্যমে চরিত্র গঠনের পদ্ধতি 

দেশ ভেদে কাল ভেদে চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষায় ধারণা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পার্থক্য দেখা যায়। তা সত্ত্বেও বলা যায়, সুপ্রাচীন কাল থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় চরিত্র গঠনের উপর বিশেষ গরুত্ব আরোপ করা হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে গুরুত্ব পায় : ন্যায়নীতি শিক্ষা, নৈতিক মান গঠন; কাজ, সততা, সৌন্দর্য, সৌজন্য, কৃতজ্ঞাবোধ ইত্যাদি গুণাবলির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি; পশুপাখির প্রতি মমত্ব ও পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি। সামগ্রিকভাবে প্রত্যক্ষ পদ্ধতির লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলি ও সুঅভ্যাস গড়ে তোলায় সহায়তা দান। চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষার পরোক্ষ পদ্ধতি হচ্ছে ইতিহাস, জীবন ও সাহিত্য থেকে পাঠের মাধ্যমে দৈনন্দিন আচরণ ও মূল্যবোধ সৃষ্টি। এভাবে মহৎ চরিত্র সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মনে আদর্শ ধারণা সৃষ্টি করা হয়।
চরিত্র গঠনে বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীর ভূমিকা ছাড়াও বয় স্কাউট, গার্ল গাইড, রেডক্রস ইত্যাদি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা গুরুত্বপূর্ণ। স্বেচ্ছা সংগঠনের মাধ্যমে মানুষ যৌথ কাজের গুরুত্ব ও আনন্দ অনুভব করতে পারে।

চরিত্র গঠনের সাধনা

সচ্চরিত্র গঠনের জন্যে প্রত্যেকের নিজস্ব প্রচেষ্টা ও সাধনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। চরিত্রবান হতে হলে লােভ- – লালসা ও অসৎ প্রবৃত্তির নানা কুপ্রলােভন পরিহার করার শক্তি অর্জন করতে হয়। লোভ লালসা ও অসৎ প্রবৃত্তির নানা কুপ্রলোভন মানুষকে পাপের পথে টানে। এসব পাপ পথ সতর্ক ও দৃঢ়চিত্তে পরিহার করে লোভকে জয় করার শক্তি অর্জন করে চরিত্রবানের আদর্শকে মশাল হিসেবে জ্বালিয়ে উন্নত জীবনের সাধনায় নিযুক্ত হলেই সুচরিত্র গঠনে এগিয়ে যাওয়া যায় । চরিত্রবান মানুষের জীবনাদর্শের আলােয় সুচরিত্র গঠনে এগিয়ে যেতে হয়। মনুষ্যত্বের অধিকারী হবার জন্যে গড়ে তুলতে হবে সুন্দর, নির্মল ও পরিচ্ছন্ন চরিত্র।

শিশু বয়সে চরিত্র গঠন

শিশুর চরিত্র যেন নির্মল ও স্বচ্ছ হয় সেজন্যে উপযুক্ত শিক্ষাদানে অভিভাবকদের পাশাপাশি তৈরি করতে হয় অনুকূল পরিবেশ। শিশুকে সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহিত করা হলে তাতে সৃজনী প্রতিভা বিকশিত হয়। শিশুর জীবনে মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটাতে হলে চাই সৎ সঙ্গ। পিতামাতা, সঙ্গীসাথী, আত্মীয়-পরিজন সৎ চরিত্রের অধিকারী না হলে এদের সাহচর্যে শিশুর মধ্যে সচ্চরিত্রের গুণগুলো সুদৃঢ় ভিত্তি পেতে পারে না। পারিবারিক পরিবেশ ছাড়াও শিশুর নৈতিক বিকাশে বিদ্যালয় জীবন ও শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রভাব গরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের কাজ শিশুকে সুশিক্ষা দেওয়া। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটানোর গুরুদায়িত্ব তাঁদেরই। আজকাল শিশুর ভালো-মন্দ চরিত্র গঠনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখছে টেলিভিশন ও স্যাটেলাইট চ্যানেলের মতো গণমাধ্যম। স্যাটেলাইটের বিভিন্ন চ্যানেলে যেসব অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় তার মধ্যে এমন অনুষ্ঠানও থাকে যা শিশুর জন্যে অনুপযোগী। শিশুস্বভাবতই টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাই অভিভাবককে অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে যাতে তাদের শিশুদের চরিত্রের ওপর অপকৃষ্ট অনুষ্ঠানের কুপ্রভাব না পড়ে। এ কারণে খুন-জখম, মারামরি ও স্থুল বিকৃত রুচির বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান শিশুর চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই এ ধরণের অনুষ্ঠান দেখা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে। তবে সর্বোপরি যে জিনিসটির ওপর অভিভাবককে বিশেষ সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে তা হলো সৎ সঙ্গ। কুসঙ্গের পাল্লায় পড়ে অনেক সম্ভাবনাময় প্রতিভা অকালে ঝরে পড়ে, হারিয়ে যায় অন্ধকারে। এ সম্পর্কে প্রবাদ আছে- ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ তাই শিশুর সঙ্গী ও বন্ধু নির্বাচনে অভিভাবকের সতর্ক বিবেচনা দরকার।

মহৎ চরিত্রের উদাহরণ

বিশ্বে যারা স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে রয়েছেন তারা ছিলেন সুন্দর, নির্মল ও পরিচ্ছন্ন চরিত্রের শক্তিতে বলীয়ান। কোনাে প্রলােভনই তাদের ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। মহৎ ও সচ্চরিত্রের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.)। তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন অন্যায়, অসত্য ও পাপের বিরুদ্ধে। যুগে যুগে ইতিহাসের পাতায় যীশুখ্রিষ্ট, বুদ্ধ, নানকের মতাে আরও যেসব মহৎ ব্যক্তিত্ব আপন মহিমায় ভাস্বর তারা সকলেই ছিলেন মানবব্রতী, সমাজব্রতী, দেশব্রতী মহাপ্রাণ সকলেই ছলেন উন্নত ও মহৎ চরিত্রের অধিকারী। বিদ্যাসাগর, রামমােহন, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শেরে বাংলা ফজলুল হক , ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে মানব্রতী, সমাজব্রতী ও দেশ্বতী মহাপ্রাণ মানুষ তাদের উন্নত ও মহৎ চরিত্রশক্তির | গুণেই অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে পেরেছিলেন। তাঁদের জীবনের মহিমা স্মরন করেই কবি লিখেছেন-
এমন জীবন হবে করিতে গঠন
মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।
চরিত্রবান ব্যক্তি ধনসম্পদে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও বংশ মর্যাদায় কাঙাল হলেও গৌরবে মহান। এ জন্যেই সুভাষিত উক্তিতে বলা হয়েছে:
রাজার প্রতাপ অর্থ-সম্পদে কিন্তু চরিত্রবানের প্রতাপ হৃদয়ে।’

উপসংহার 

বর্তমান বিশ্বে সর্বত্র বাড়ছে মূল্যবােধের অবক্ষয়। সততা, ন্যায়নীতি হচ্ছে বিপর্যস্ত। চরিত্রের মহিমাকে উপেক্ষা করতে বসেছে মানুষ। লােভ-লালসা, ঈর্ষা-হিংসা, অন্যায়-দুর্নীতি ক্রমেই আচ্ছন্ন করছে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে। হীনস্বার্থ হাসিলের অনৈতিক পন্থায় চালিত হচ্ছে একশ্রেণির লােক। এ অবস্থায় জাতীয় জীবনে চাই চরিত্রশক্তির নবজাগরণ। চরিত্র হরানাে প্রজন্মকে শােধরানাে কঠিন। সুতরাং নতুন প্রজন্মকে বেড়ে উঠতে হবে চরিত্রের মহান শক্তি অর্জন করে। আর তা করতে পারলেই আমাদের ভবিষ্যৎ হয়ে উঠবে সুন্দর ও সার্থক। 


 এই রকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন। এর পাশাপাশি গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন। 


Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button