বাংলা রচনা

রচনাঃ মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার

ভূমিকা

বর্তমান বিশ্ব সভ্যতা যে কয়টি মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন তার মধ্যে মাদকাসক্তি অন্যতম। বিশ্ব জুড়ে আজ মাদকাসক্তি একটি জটিল সামাজিক ব্যাধিরূপে বিস্তার লাভ করেছে। আমাদের সমাজে এই দূরারোগ্য ব্যাধির তীব্রতা আরো বেশি প্রবল। এর শিকার হয়ে প্রতিটি দেশের যুব সমাজ তাদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। দিন যত যাচ্ছে এর ভয়াবহতা আরো বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এখনই উচিত মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে দৃঢ় অঙ্গিকারবদ্ধ হওয়া।

মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তি

মাদকদ্রব্য হচ্ছে সেসব দ্রব্য বা বস্তু যা গ্রহণের ফলে মানুষের স্বাভাবিক আচরণের পরিবর্তন ঘটে। শুধু তাই নয় এসব দ্রব্যের প্রতি তাদের এক ধরণের নেশার সৃষ্টি হয়। এই সকল মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে নেশা সৃষ্টি করাকে মাদকাসক্তি বলে। মাদকদ্রব্যের এই নেশা সম্পর্কে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স.) বলেছেন- ‘নেশা জাতীয় যে কোনো দ্রব্যই মদ, আর যাবতীয় মদই হারাম।’ সকল প্রকার নেশা জাতীয় দ্রব্য হারাম হওয়া সত্ত্বেও এসব দ্রব্যসামগ্রীর প্রতি মানুষের আকর্ষণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে- ‘মাদকাসক্তি হচ্ছে চিকিৎসা গ্রহণযোগ্য নয় এমন দ্রব্য অতিরিক্ত পরিমাণে ক্রমাগত বিক্ষিপ্তভাবে গ্রহণ করা এবং এসব দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া।’

মাদকদ্রব্যের প্রকারভেদ

আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন ধরণের মাদকদ্রব্য লক্ষ্য করা যায়। সভ্যতার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মাদকদ্রব্যেরও যথেষ্ট পরিমাণে উন্নতি হয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকারের মাদকদ্রব্য দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে যেসব মাদকদ্রব্যের সেবন সর্বাধিক বেশি সেগুলো হলো- গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা, রেকটিফাইড স্পিরিট, মদ, বিয়ার, তাড়ি, পঁচুই, কোকেন, আফিম, মারিজুয়ানা, ভাং, ক্যানাবিস, হাসিস, ঘুমের ওষুধ, প্যাথেড্রিন ইনজেকশন ইত্যাদি।

মাদকদ্রব্যের উৎস

আধুনিক বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কম-বেশি মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। কোনো দেশে কম আবার কোনো দেশে অনেক বেশি। যেমন, গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (লাওস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড), গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান), গোল্ডেন ওয়েজ-এ তিন স্থানে পপি উৎপাদিত হয়। এই পপি ফুলের নির্যাস থেকে আফিম এবং এই আফিম থেকেই সর্বনাশা হেরোইন তৈরি হয়। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, জ্যামাইকা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, ঘানা, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও থাইল্যান্ডসহ ১১টি দেশে মারিজুয়ানা উৎপন্ন হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, বলিভিয়া প্রভৃতি দেশ কোকেন উৎপাদনে বিখ্যাত। তাছাড়া এশিয়া মহাদেশের প্রায় অনেক দেশেই আফিম, হেরোইন ও হাসিস উৎপন্ন হয়।

মাদকাসক্তির কারণ

মাদকাসক্তির বহুবিধ কারণ রয়েছে। আমাদের সমাজে বিভিন্ন কারণে মাদকাসক্তির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানী, গবেষক ও চিকিৎসকরা মাদকাসক্তির অন্তরালে বিভিন্ন কারণের কথা বলেছেন। নিম্নে তা বর্ণনা করা হলো-
➥ হতাশা: মাদকাসক্তির অন্যতম প্রধান একটি কারণ হলো হতাশা। এই হতাশার করণেই ব্যক্তি তার নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। যার ফলে সাময়িকভাবে আত্মমুক্তির জন্য সর্বনাশা মাদকাসক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে।
➥ সঙ্গদোষ: মাদকাসক্তির জন্য সঙ্গদোষ আরেকটি মারাত্মক কারণ। নেশাগ্রস্থ বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে এটি বিস্তার লাভ করে।
➥ কৌতূহল: কৌতূহলও মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ। অনেকেই মাদকাসক্তির ভয়াবহতা জেনেও কৌতূহলবশত মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে।
➥ সহজ আনন্দ লাভের বাসনা: অনেক সময় মানুষ মাদককে আনন্দ লাভের সহজ উপায় হিসাবে মাদকগ্রহণ করে এবং ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
➥ মনস্তাত্ত্বিক বিশৃঙ্খলা: তরুণদের মধ্যে মাদক গ্রহণের জন্য এটি অন্যতম কারণ। পরীক্ষায় ফেল, পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা, বেকারত্ব ইত্যাদি কারণে তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
➥ ধর্মীয় মূল্যবোধের বিচ্যুতি: ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষকে সচেতন করে তোলে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ধর্মীয় মূল্যবোধের বিচ্যুতি হওয়ার ফলে মাদকাসক্তির বিস্তার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
➥ পরিবারের অভ্যন্তরে মাদকের প্রভাব: অনেক সময় দেখা যায় পরিবারে পিতা-মাতার নেশার অভ্যাস থাকে। ফলে তাদের সন্তান সহজেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
➥ মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা: বর্তমানে আমাদের দেশে মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতার কারণে মাদকাসক্তদের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।সুতরাং, সামগ্রিকভাবে হতাশা, আদর্শহীনতা, বিভ্রান্তি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক অস্তিরতা, সামাজিক ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয় ইত্যাদি কারণে মাদকাসক্তির সংখ্যা দিন দিন বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মাদকাসক্তির প্রভাব

সারাবিশ্বে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও চোরাচালানের মাধ্যমে এর ব্যাপক প্রসার ঘটায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি এক মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। মাদকের নিষ্ঠুর ছোবলে অকালে ঝরে পড়ছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ। অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে বহু তরুণের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাদকাসক্তির ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিম্নে আলোচনা করা হলো-
➥ যুব সমাজের ওপর প্রভাব: মাদকদ্রব্যের অবৈধ পাচার আমাদের দেশের যুব সমাজের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। যার ফলে যুব সমাজের বিরাট একটা অংশ অবচেতন ও অকর্মণ্য হয়ে পরছে।
➥ সামাজিক বিশৃঙ্খলা: মাদকাসক্তরা মাঝে মাঝে মাদকগ্রহণের জন্য চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ইত্যাদি বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে। যার ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়।
➥ শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি: মাদকদ্রব্য সেবনের ফলে তারা মারাত্মকভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবার ও সমাজে তারা বিভিন্ন অস্বাভাবিক আচরণ করে।
➥ পারিবারিক ভাঙ্গন ও হতাশা বৃদ্ধি: মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তির প্রভাবে আমাদের সমাজে পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ এবং এ সম্পর্কিত হতাশা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। পারিবারিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি নষ্ট হয়।
➥ নৈতিক অধঃপতন: মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বাহ্যিক আচরণ প্রকাশ পায়। যেকোনো ব্যাপারে তখন ব্যক্তির মধ্যে চরম নৈতিক অধঃপতন লক্ষ্য করা যায়।
➥ শিক্ষার ওপর প্রভাব: অনেক মেধাবী ও ভালো ছাত্রছাত্রী মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জীবনকে নষ্ট করছে। তাই দেখা যায় মাদকাসক্তি সমস্যা আমাদের দেশের শিক্ষার ওপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের উপায়

মাদকদ্রব্যের এই সর্বনাশা ব্যবহার বর্তমান বিশ্বে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এ জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ সমূহ- গ্রহণ করা বাঞ্চনীয়-
– মাদকদ্রব্য উৎপাদন ও আমদানি রোধ করার জন্য প্রতিরোধ কর্মসূচি আরো জোরদার করা।
– মাদক চোরাচালান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা।
– সমাজের প্রত্যেক মানুষকেই এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করা।
– বেকারত্ব হ্রাস করা এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা।
– স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বইয়ে মাদকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা।
– আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকরী ভূমিকা পালন করা।
– সরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি করা।
– সভা, সমিতি, সেমিনার ও আলোচনার মাধ্যমে মাদক প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা।
– মাদক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়ন করা।

মাদকাসক্তির প্রতিকার ও বাংলাদেশ

মাদকাসক্তির প্রতিকার আন্দোলনে বাংলাদেশের ভূমিকা দিন দিন তরান্বিত হচ্ছে। আধুনিক (আমরা ধূমপান নিবারণ করি) সংস্থাটি মাদক নিরাময় আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদি গণমাধ্যমগুলোও সব সময় মাদক নিরাময়ে কাজ করছে। তারা সব সময় মাদকাসক্তির ভয়ানক পরিণাম নিয়ে বিভিন্ন নাটক প্রচার করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করছে। এছাড়া বাংলাদেশে বর্তমানে Narcoties Control Act 1990 চালু আছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ ও প্রতিবছর ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের পাচার, অপব্যবহার বিরোধী দিবস পালন কর আসছে।

উপসংহার

সভ্যতার এই আধুনিক যুগে মাদকাসক্তি কালসাপ রূপ ধারণ করেছে। এর ছোবলে হারিয়ে যাচ্ছে অজস্ত্র তরুণ-তরুণীর সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এর প্রভাব বাংলাদেশে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এটি প্রতিরোধের ব্যবস্থা না করলে মাদকের অতল গর্ভে হারিয়ে যাবে আমাদের দেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। তাই মাদক প্রতিরোধের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সামাজিক প্রতিরোধ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা উচিত।


 এই রকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন। এর পাশাপাশি গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন। 

Google News

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button