
সম্প্রদায়গত সম্প্রীতি : সম্প্রদায়গত সম্প্রীতি শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানের উপযোগী একটি ভাষণ তৈরি করা কর।
আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানের মাননীয় সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথিবৃন্দ এবং আগত সম্মানিত সুধীমণ্ডলী, আসসালামু আলাইকুম। আমি প্রথমেই এ অনুষ্ঠানের আয়োজকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই এ রকম একটি বিষয় নিয়ে আলোচনার অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য, যা আমাদের বাঙালিসত্তার নিরপেক্ষতা প্রমাণে সহায়ক হবে। আমি এতক্ষণ আমার আগের সুযোগ্য বক্তার জ্ঞানগর্ভ কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম আর ভাবছিলাম কী বলব। কারণ তিনি অনেক কথাই বলেছেন সম্প্রদায়গত সম্প্রীতি সম্পর্কে। তারপরও আমার দৃষ্টিভঙ্গিটি তুলে ধরতে চাই।
সুধীবৃন্দ, আপনারা অনেকেই জানেন কিছুদিন আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় পূজামণ্ডপে উচ্ছৃঙ্খল কিছু মানুষের তাণ্ডবের কথা লিখেছে জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো। প্রতি বছরই দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে এটাই তো স্বাভাবিক। সেখানে অন্যের ধর্মের মানুষ বাগড়া দেবে কেন? প্রতিটি ধর্মের মর্মবাণীই তো আমাদের তা-ই শিক্ষা দেয়। তার মানে বিষয়টি এমন দাঁড়াচ্ছে যে, ইদানীং আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিটা হীন মানসিকতার কিছু মানুষের জন্য রক্ষা করা যাচ্ছে না।
অভ্যাগত সম্মানিত সুধীমণ্ডলী, আপনারা জানেন সাম্প্রদায়িকতা হলো সম্প্রদায়ভিত্তিক জাত্যভিমান। যখন একটি সম্প্রদায় নিজেকে অন্য সব সম্প্রদায় কিংবা কোনো একটি বিশেষ সম্প্রদায় থেকে উৎকৃষ্ট মনে করে, নিজেদের সবকিছুকে ভালো মনে করে, অন্য সম্প্রদায়কে নিকৃষ্ট কিংবা ছোট মনে করে তখন সেই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতা হলো এমন একটি বোধ যা মানুষকে নিজেদের সম্প্রদায়কে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শেখায় এবং সেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের ক্ষতি করার জন্য, তাদেরকে দমিয়ে রাখার জন্য, ধ্বংস করার জন্য মেতে ওঠে বর্বরতায়।
সুধীমণ্ডলী, ধর্মের ভিত্তিতেই মানুষের পৃথক পৃথক সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি গড়ে ওঠে। যেমন কেউ মুসলিম সম্প্রদায়ের আবার কেউ হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ। যদিও ধর্ম সম্প্রদায় সৃষ্টি করে, তাই বলে ধর্ম কখনো কাউকে সাম্প্রদায়িক হতে বলে না। তাছাড়া ধর্ম কখনো সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থনও দেয় না। কারণ সব ধর্মই মানুষকে শান্তি ও সম্প্রীতির পথ দেখায়। আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বলতে একসাথে একই সমাজে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সহাবস্থানকে বোঝায়। সেখানে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে কোনো জাত্যভিমান থাকে না। কেউ কাউকে ছোট ভাবে না । কেউ কাউকে বড়ও ভাবে না। কেউ নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে না। কেউ কাউকে শত্রু হিসেবে গণ্য করে না। একই সমাজ ও রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে সবাই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সাম্প্রদায়িকতা মানুষকে এতই অন্ধ ও বিচার-বুদ্ধিহীন করে দেয় যে মানুষে-মানুষে হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, ক্রোধ, মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি সৃষ্টি হয়। এটা মানুষকে সংঘাত ও সংঘর্ষে উৎসাহী করে তোলে। মানুষকে করে সহিংসতাপ্রেমী ও যুদ্ধবাজ।
সম্মানিত শ্রোতৃমণ্ডলী, বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষক্রিয়া আমাদের মাঝে দিন দিন ছড়িয়ে পড়ছে, তা থেকে আমাদের সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ জন্য সবার প্রতি সহযোগিতা, সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যেন সংখ্যালঘুরা নিরাপদভাবে, দ্বিধাহীনভাবে সবকিছুতে অংশ নিতে পারে। সবার ভেতর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে। সরকার, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সংখ্যালঘুদের অনুকূল হতে হবে। ধর্মান্ধতা ত্যাগ করে মানুষের প্রতি, অন্য ধর্মের প্রতি, সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে যে অন্য ধর্মের নিরীহ, নির্দোষ মানুষকে হত্যা করার নাম ‘জিহাদ’ বা ‘ক্রুসেড’ নয়। আর তা হলেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে।
পরিশেষে কবির ভাষায় বলতে চাই, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। কবির এ বাণী মনে-প্রাণে বিশ্বাস করলে কোনো মানুষের পক্ষে সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করা সম্ভব নয়। আমাদের সবার শুভবোধ জাগ্রত হোক, এ কামনায় আমার বক্তব্য শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ ।