ইসলাম ও জীবন

যাকাতুল ফিতরা কত টাকা? ফিতরা আদায়ের নিয়ম বিস্তারিত জানুন

5/5 - (2 votes)

যাকাতুল ফিতরাঃ যাকাতুল ফিতরা বা সদকাতুল ফিতর কীভাবে আদায় করবেন, কত টাকা ফিতরা দিবেন, ফিতরা আদায়ের ফজিলত, কাদের উপর ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব, কখন ফিতরা আদায় করবেন, যাদের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করাবো।

ফিতরা কি?

‘সদকাহ্’ শব্দের অর্থ হল দান। ইসলামী শরিয়াতের পরিভাষায় “যে দান দ্বারা আল্লাহ্’র নিকট ছাওয়াবের আশা করা যায়, তাকে সদকাহ্ বলে।” ‘ফিত্র’ শব্দের অর্থ হল রোযা না রাখা। নিসাব পরিমাণ মালের মালিকের উপর ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় যে দান ওয়াজিব হয়, তাকে ‘সদকাতুল ফিতর’ বলে।

ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদেকের সময় যার নিকট যাকাত ফরয হওয়া পরিমান অর্থ-সম্পদ থাকে তার উপর অর্থ থাকে তার উপর সদকায়ে ফিতর বা ফিতরা ওয়াজিব। তবে যাকাতের নেছাবের ক্ষেত্রে ঘরের আসবাবপত্র বা ঘরের মূল্য ইত্যাদি হিসাবে ধরা হয় না কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় আসবাবপত্র ব্যতিত অন্যান্য আসবাবপত্র, সৌখিন দ্রব্যাদি, খালি ঘর বা ভাড়া ঘর (যার ভাড়ার উপর জীবিকা নির্ভরশীল নয়) এসব কিছুর মূল্য হিসাবে ধরা হবে।

ফিতরা আদায়ের ফযিলত

হাদিসে এসেছে- রাসুলূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আরাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ

আল্লাহ্ পাক তোমাদের জন্য যাকাতুল ফিত্র তথা সদকাতুল ফিত্রকে ফরয (অবশ্য পালনীয়) করেছেন। তা রোযাদারের বেহুদা কাজ ও অশ্লীলতা থেকে পবিত্রকারী এবং মিসকীনদের খাবার। যে তা ঈদুল ফিতরের নামাযের পূর্বে আদায় করবে, এটা মকবুল যাকাত (দান)। আর যে নামাযের পরে আদায় করবে, তা অন্যান্য সদকাহ্’র ন্যায়-ই সদকাহ্। (কানযুল্ উম্মাল, হাদিস নং- ২৪১৩৮)

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন-

বান্দাহ্’র রোযা (রবের নিকট) পৌঁছে না; আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী ঝুলন্ত অবস্থায় রয়ে যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত না সদকাতুল ফিতর আদায় না করে। কানযুল উম্মাল, হাদিস নং- ২৪১৩০

ফিতরার হুকুম

সদকাতুল ফিতর নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর আদায় করা ওয়াজিব। হাদিস শরিফে এসেছে:

ইবনু উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসলিমদের প্রত্যেক আযাদ, গোলাম পুরুষ ও নারীর পক্ষ হতে সদকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর অথবা যব-এর এক সা’ পরিমাণ আদায় করা ফরয করেছেন। সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ১৫০৪

যাদের উপর ফিতরা ওয়াজিব

যে ব্যক্তি যাকাত আদায় করার উপযুক্ত, তার উপর ফিতরা আদায় করাও ওয়াজিব। অর্থাৎ- কোন ব্যক্তি জীবিকা নির্বাহের আবশ্যকীয় উপকরণ, যথা- আবাসপত্র, বাসগৃহ, পরিধেয় বস্ত্র, খাদ্যদ্রব্য, ঘরের সরঞ্জামাদী এবং খিদমতের গোলাম ব্যতীত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা এর সমমূল্যের কোন সম্পদের মালিক থাকলে, তার উপর সদকায়ে ফিত্র ওয়াজিব হবে।

সদকাতুল ফিত্র ওয়াজিব হওয়ার জন্য-

  • সম্পদ বর্ধনশীল হওয়ার যোগ্যতা রাখা শর্ত নয়।
  • পূর্ণ একবছর মালিকানায় থাকাও শর্ত নয়।
  • বরং ঈদুল ফিতরের দিন সুব্হে সাদিকের সময় উপরোক্ত পরিমাণ মালের মালিক থাকলেই সদকায়ে ফিত্র ওয়াজিব হবে।

যাদের পক্ষ হতে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব

হাদিস শরিফে এসেছে

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক স্বাধীন-ক্রিতদাস, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় মুসলমানের যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন এক সা‘ পরিমাণ খেজুর বা যব ফরয করেছেন। তিনি লোকদের ঈদের নামাযে বের হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন। বুখারি ও মুসলিম

সুতরাং ফিতরা আদায় করতে হবে-

  • নিজের পক্ষ হতে।
  • নিজের নাবালেগ সন্তানের পক্ষ হতে।
  • নিজের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান যদি মতিভ্রম বা পাগল হয়, তাদের পক্ষ হতেও ফিতরা আদায় করতে হয়

এদের ছাড়া আর কারো পক্ষ হতে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। যেমন- প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান এবং স্ত্রী ও পিতা-মাতার পক্ষ হতে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। তবে কেউ করলে আদায় হয়ে যাবে।

কখন ফিতরা আদায় করবে

ঈদের দিন সুবহে সাদিকের পর ঈদের নামাযের পূর্বে সদকায়ে ফিতর আদায় করা মুস্তাহাব। কোন কারণ বশতঃ তখন আদায় করতে না পারলে পরে আদায় করলেও তা আদায় হয়ে যাবে। আবার কেউ যদি ঈদের দিনের আগেও ফিতরা আদায় করে দেয়, তবুও আদায় হয়ে যাবে। রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের নামাযের পূর্বেই সদকায়ে ফিতর আদায় করতেন।

নবীজি (সঃ) বলেনঃ

যে তা ঈদুল ফিতরের নামাযের পূর্বে আদায় করবে, এটা মকবুল যাকাত (দান)। আর যে নামাযের পরে আদায় করবে, তা অন্যান্য সদকাহ্’র ন্যায়-ই সদকাহ্।

  • ঈদের দিন সুবহে সাদিকের সময় সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয়। সুতরাং কেউ যদি সুবহে সাদিকের পূর্বেই ইনতিকাল করে, তবে তার ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়।
  • সুবহে সাদিকের পূর্বে যদি কারো সন্তান জন্ম লাভ করে বা দরীদ্র ধনী হয়ে যায় বা অমুসলিম মুসলিম হয়ে যায়, তবে তাদের ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব হবে।
  • সুবহে সাদিকের পর যদি কারো সন্তান জন্ম নেয় বা দরীদ্র ধনী হয় বা অমুসলিম মুসলিম হয়, তাদের উপর ফিতরা ওয়াজিব নয়। আবার সুবহে সাদিকের পূর্বে কোন ধনী দরীদ্র হয়ে গেলে, তাদের উপরও ফিতরা ওয়াজিব নয়।

যে জিনিস দ্বারা ফিতরা আদায় করবে এবং এর পরিমাণ

হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জমানায় আমরা সদকাতুল ফিতর দিতাম এক সা‘ (সাড়ে তিন কেজি প্রায়) খাদ্যবস্তু, তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল: যব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর। (বুখারি: ১/২০৪)

তিনি আরও বলেন: আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা‘ খাদ্যবস্তু, যেমন: এক সা‘ যব, এক সা‘ খেজুর, এক সা‘ পনির, এক সা‘ কিশমিশ। (বুখারি: ১/২০৫)

উল্লেখিত বর্ণনার আলোকে বুঝা যায় যে, পাঁচটি খাদ্যসামগ্রী দিয়ে সাদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়। যারা যে জিনিস দিয়ে ফিতরা দিতে ইচ্ছুক, সেসব জিনিস বা সেগুলোর মূল্য পরিশোধে ওই জিনিসের ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। তাহলো-

  • ১. গম বা আটা: আটা বা গমের ক্ষেত্রে অর্ধ সা‘। যার সমপরিমাণ ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম।
  • ২. যব: যবের ক্ষেত্রে এক সা‘। যার পরিমাণ ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম।
  • ৩. খেজুর: খেজুরের ক্ষেত্রে ১ সা‘ ফিতরা দিতে হবে। যার পরিমাণ ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম।
  • ৪. কিসমিস: কিসমিসের ক্ষেত্রেও এক সা‘। যার পরিমাণ ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম।
  • ৫. পনির: পনিরের ক্ষেত্রেও ১ সা’ ফিতরা দিতে হবে। যার পরিমাণ ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম।

সাদকায়ে ফিতরা কত টাকা ২০২৩ (চট্রগ্রাম)

চলতি রমজানে বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী সর্বনিম্ন ফিরতা ধরা হয়েছে ১০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২৩০০ টাকা। তবে এটি শুধুমাত্র চট্রগ্রাম জেলার জন্য প্রযোজ্য।

২০২৩ সালে ফিতরার টাকার পরিমান
২০২৩ সালে ফিতরার টাকার পরিমান

ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক নির্ধারিত ফিতরার টাকা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২০২৩ সালের জন্য সাদাকাতুল ফিতরা জনপ্রতি সর্বনিম্ম ১১৫ টাকা ও সর্বোচ্চ ২৬৪০ টাকা নির্ধারণ করেছে।

[table id=34 /]

সাদকায়ে ফিতরা-এর মাসায়েল

  • রোযা না রাখলে বা রাখতে না পারলে তার উপরও ফিতরা দেয়া ওয়াজিব । এ কথা নয় যে, রোযা না রাখলে ফিতরাও দিতে হয়না।
  • সদকায়ে ফিতর/ফিতরা নিজের পক্ষ থেকে এবং পিতা হলে নিজের না-বালেগ সন্তানের পক্ষ থেকে দেয়া ওয়াজিব । বালেগ সন্তান, স্ত্রী, স্বামী, চাকর-চাকরানী, মাতা-পিতা প্রমুখের পক্ষ থেকে দেয়া ওয়াজিব নয় । তবে বালেগ সন্তান পাগল হলে তার পক্ষ থেকে দেয়া পিতার উপর ওয়াজিব।
  • একান্নভুক্ত পরিবার হলে বালেগ সন্তান, মাতা, পিতার পক্ষ থেকে এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে ফিতরা দেয়া মোস্তাহাব, ওয়াজিব নয় ।
  • সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব না হলেও সঙ্গতি থাকলে দেয়া মোস্তাহাব এবং অনেক ছওয়াবের কাজ ।
  • ফিতরায় ৮০ তোলার সেরের হিসাবে ১ সের সাড়ে বার ছটাক (১ কেজি ৬৬২ গ্রাম) গম বা আটা কিংবা তার মূল্য দিতে হবে । পূর্ণ দুই সের (১ কেজি ৮৬৬ গ্রাম) বা তার মূল্য দেয়া উত্তম ।
  • ফিতরায় যব দিলে ৮০ তোলার সেরের হিসাবে ৩ সের নয় ছটাক (প্রায় ৩ কেজি ৩২৫ গ্রাম) দিতে হবে । পূর্ণ ৪ সের (৩ কেজি ৭৩২ গ্রাম) দেয়া উত্তম ।
  • গম, আটা ও যব ব্যতীত অন্যান্য খাদ্যশস্য যেমন ধান, চাউল, বুট, কলাই, মটর ইত্যাদি দ্বারা ফিতরা আদায় করতে চাইলে বাজার দরে উপরোক্ত পরিমাণ গম বা যবের যে মূল্য হয় সেই মূল্যের ধান চাউল ইত্যাদি দিতে
    হবে।
  • ফিতরায় গম, যব ইত্যাদি শষ্য দেয়ার চেয়ে তার মূল্য- নগদ টাকা পয়সা দেয়া উত্তম ।
  • ফিতরা ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাযের পূর্বেই দিয়ে দেয়া উত্তম । নামাযের পূর্বে দিতে না পারলে পরে দিলেও চলবে । ঈদের দিনের পূর্বে রমযানের মধ্যে দিয়ে দেয়াও দোরস্ত আছে ।
  • যাকে যাকাত দেয়া যায় তাকে ফিতরা দেয়া যায় ।
  • একজনের ফিতরা একজনকে দেয়া বা একজনের ফিতরা কয়েকজনকে দেয়া উভয়ই দুরস্ত আছে । কয়েকজনের ফিতরাও একজনকে দেয়া দুরস্ত আছে কিন্তু তার দ্বারা যেন সে মালেকে নেছাব না হয়ে যায় । অধিকতর উত্তম হল একজনকে এই পরিমাণ ফিতরা দেয়া, যার দ্বারা সে ছোট-খাট প্রয়োজন পূরণ করতে পারে বা পরিবার-পরিজন নিয়ে দু’তিন বেলা খেতে পারে ।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button