বৃষ্টিভেজা দিন (রচনা)

বৃষ্টিভেজা দিন রচনা
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা, কেমন আছো সবাই? আশা করি ভালো আছো। তোমরা অনেকেই বৃষ্টিভেজা দিন রচনা নিয়ে আমাকে অনুরোধ করেছিলে। তাই আজকে তোমাদের জন্য রচনাটি নিয়ে হাজির হলাম। আশা করি রচনাটি তোমাদের ভালো লাগবে।
[divider style=”solid” top=”10″ bottom=”10″]
ভূমিকা
একটানা বৃষ্টিতে মন ভরে না, একা আর ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না-গৃহবন্দি এমন জীবন ভালো না লাগাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে শহুরে জীবনে। কিন্তু সেটি যদি হয় বৃষ্টিভেজা দিন, তাও আবার লোকালয় ছেড়ে কোনো নিভৃত পল্লিতে, তাহলে তো কথাই নেই। আমার জীবনে সে রকম একটি দিন এসেছিল, ঝুম বৃষ্টিতে ভেজার দিন। আবেশে মন ভরিয়ে দেয়ার দিন। সে রকম একটি বৃষ্টিভেজা দিনের কথাই আজ বলব।
বর্ষার রূপ ও আমার অনুভূতি
আমাদের বাঙালি জীবনে বর্ষার আবেদন কতখানি তা ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ। বর্ষা তার অপার সৌন্দর্য ও করুণা দিয়ে বাংলার প্রকৃতি ও তার সন্তানদের পরিপুষ্ট করে রাখে। এই বর্ষা মানবমনের সাথেও সর্বদা বিচিত্র খেলায় মত্ত থাকে। একই অঙ্গে বহুরূপ ধারণকারী বর্ষা যে অপার সৌন্দর্য নিয়ে আবির্ভূত হয়, তা বাক্য-কথায় আবদ্ধ করা যায় না।
এ শুধু নীরবে অনুভব করতে হয়। বর্ষণমুখর দিন আমার জীবনে বহুবার ধরা দিয়েছে। কিন্তু সেদিনের মতো এমন বর্ষণমুখর দিন আমি কখনো অনুভব করিনি। যা আমার মনকে দোলা দিয়ে গেছে। চিত্তকে করেছে বর্ণিল। যা স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে প্রথম প্রণয়ের
মতো।
[box type=”note” align=”” class=”” width=””]আরও পড়ুনঃ রচনাঃ বর্ষায় বাংলাদেশ[/box]
বৃষ্টিভেজা দিন উপভোগের সুযোগ
আমি শহরে বাস করি। শহরের ইট-কাঠের খাঁচায় বর্ষণমুখর দিনকে উপভোগ করা যায় না। মানবসভ্যতার এ আগ্রাসনে বর্ষাদেবী শহরে তার করুণা বর্ষণ করলেও, নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মেলে ধরতে পারেন না। এ বর্ষণে তাই কোনো ছন্দ থাকে না, গন্ধ থাকে না, ভাষা থাকে না ৷ আমার জীবনে তাই বর্ষা আগে ছিল শুধু বিন্দু বিন্দু জলকণার অবিরাম পতন। বর্ষণমুখর দিনকে আমি প্রথম উপলব্ধি করতে শিখি আমার এক দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে। বিয়েটা ছিল মধুমতি নদীর পাড়ের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। ছবির মতো সাজানো-গোছানো, সবুজ প্রকৃতির অপার স্নেহ-মমতায় লালিত সে গ্রাম। শ্রাবণ মাসের সেই গ্রাম্য প্রকৃতিতে বর্ষাদেবী উন্মুক্ত করেছিল তার পরিপূর্ণ রূপ। মনে হয়েছিল কবির মতো আমিও লিখি-
বৃষ্টি পড়ে রিমঝিমিয়ে, রিমঝিমিয়ে
টিনের চালে, গাছের ডালে
বৃষ্টি পড়ে হাওয়ার তালে।
বৃষ্টিভেজা দিনের বর্ণনা
আমার জীবনে সেই বর্ষণমুখর দিনটি আমার স্মরণীয় ঘটনাগুলোর মধ্যেই পড়ে। সেই বর্ষণমুখর দিনের স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে বিয়ে বাড়ির উঠোন, ঘর, কোলাহল, সাজসজ্জা আর সেখানকার মানুষের সরলতা । বিয়ের দিন রাতেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়েছিল। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি ঝুম বৃষ্টি। সকালের সূর্যের আলো সেই বৃষ্টির ধারায় ম্লান হয়ে উঠোন জুড়ে এক মোহনীয় হলুদ রঙের আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। বিয়ে বাড়ির লাল-পাড় হলুদ শাড়ি পরা কিশোরীরা খালি পায়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল। কৃষ্ণচূড়া ফুল যেমন প্রকৃতির অন্য সব সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে আমাদের চোখে আপন মহিমায় আভাসিত হয়, সেই কিশোরীদেরও তখন সে রকম মনে হচ্ছিল।
তাদের প্রাণখোলা হাসি ও চঞ্চলতা বিয়ে বাড়িকে প্রাণবন্ত করে রেখেছিল। বিয়ে বাড়ির লাল-নীল কাগজ, গাঁদা ফুল, কলাগাছের সাথে প্রকৃতি ও বর্ষার আয়োজন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন জানালার পাশে একা বসে আছি। বাইরে বৃষ্টির অবিরাম ছন্দোবদ্ধ সংগীত। প্রকৃতি আস্তে আস্তে অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যায়। গাছের পাতাগুলো বৃষ্টির পানিতে মৃদুমন্দ কাঁপছে। পানির শব্দ ও বৃষ্টির গন্ধ পুরো পরিবেশকে তখন মোহনীয় করে তুলেছে। খড়ের চালের পানি মাটির ঘরের কিনারা দিয়ে পড়ে এক নির্দিষ্ট শৃঙ্খলায় বয়ে চলেছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো স্রোতস্বিনী নদী তার বুক ভরে পলি নিয়ে অন্য অজানা কোনো ভূমিকে পরিপুষ্ট করতে প্রবলবেগে ছুটে চলছে। ঘরের দরজার কাছে, খেজুর গাছের তৈরি সিঁড়ির গোড়ায় কতগুলো হাঁস জড়ো হয়ে মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছে। আর মাঝে মাঝে অসাধারণ নৃত্যের ভঙ্গিমায় পাখা ঝাড়া দিয়ে উঠছে।
[box type=”note” align=”” class=”” width=””]আরও পড়ুনঃ বাংলার ষড়ঋতু – রচনা (১৫ পয়েন্ট)[/box]
এ দৃশ্য দেখে আমি আর বৃষ্টিতে ভেজার লোভ সামলাতে পারলাম না। যে অবস্থায় ছিলাম সে অবস্থাতেই নেমে পড়ি উঠোনে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মাথায় পুরো শরীর ভিজে যায় আমার। তারপর উঠোন ছেড়ে বাইরে পা রাখি। দেখি ছোট ছোট ছেলে- মেয়েরা মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছে আর হল্লা করছে। অনেক কিশোরীকেও দেখলাম কী সব বলে হেসে গড়িয়ে পড়ছে একে অন্যের গায়ে। তাদের এমন আনন্দঘন দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি চলে আসি আরো খানিকটা সামনে। অদূরে দেখলাম কয়েকজন কিশোর ফুটবল নিয়ে খেলছে। কেউ একজন পড়ে যেতেই অন্যেরা হাসির তুফান ছুটাচ্ছে। আহ্! কী যে আনন্দ নিয়ে তাদের দিন কাটে বৃষ্টি এলে। সে সময় আমার রবি ঠাকুরের গানের কথা মনে পড়ে-
মেঘের পরে মেঘ জমেছে
আঁধার করে আসে
আমায় কেন বসিয়ে রাখো
একা দ্বারের পাশে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সেদিনই প্রথম আবিষ্কার করলাম এ গানের মর্মকথাকে। আর বুঝলাম কেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষাকে নিয়ে এত আকুলতা, কবি-সাহিত্যিকদের এত আয়োজন। আসলে এ বর্ষা একধরনের মাদকতা তৈরি করে, একে পুরোপুরি পাওয়া যায় না, শুধু অনুভব করতে হয়। এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হয়। সেদিনের সে স্মৃতি তাই আমার স্মৃতিতে আজও অম্লান হয়ে আছে। থাকবে আজীবন পরিশেষে পল্লিকবি জসীম উদ্দীনের কবিতার ভাষায় আমার সেদিনের বৃষ্টিভেজা দিনের অনুভূতি বর্ণনার ইতি টানছি-
আজিকে বাহির শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে
বেণু বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে পল্লিকবি জসীম উদ্দীন
উপসংহার
বর্ষা এ দেশের মানুষের মনে-প্রাণে এক বিরাট স্থান জুড়ে আছে। আমাদের বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিকের রচনায় বর্ষার বন্দনা অনেক ব্যাপক। বর্ষাকে নিয়ে লেখেননি এমন কবি-সাহিত্যিক পাওয়া দুষ্কর। সেদিনের বৃষ্টিভেজা দিনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি বর্ষা মানুষের মনে এক অন্য রকম ভাবের উদয় ঘটায়। প্রকৃতিও যেন একাকার হয় বর্ষার নিবিড়তায়।