ভূমিকা
বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলাের একটি। বাংলাদেশের দরিদ্র হওয়ার মূলে রয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের নারীরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ফলে তারা ইচ্ছা থাকলেও কোনাে গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারে না। একমাত্র শিক্ষাই পারে একটি নারীকে দায়িত্ব পালনে যােগ্য করে তুলতে।
সামাজিক পটভূমিতে বাংলাদেশে নারীশিক্ষা
আমাদের দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ এখনাে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। ফলে ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারে না। যেখানে একজন দরিদ্র পিতামাতা একটি ছেলেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হিমশিম খায়, সেখানে তারা একটি মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠাননার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনাও করতে পারে না। অথচ নারীদেরকে শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রমের মূলধারার সাথে যুক্ত করতে না পারলে কোনােভাবেই সর্বজনীন শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়।
নারীশিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা
সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও জীবননির্বাহে সমান সূচনা পালন করে আসছে। বর্তমান প্রতিযােগিতাময় বিশ্বে একটি সমাজের উন্নতি নারী সমাজের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। নারী শুধু অন্তঃপুরবাসিনী নয়, পুরুষের পাশাপাশি তারাও এখন সমাজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে সমাজের উন্নতি সাধন করে থাকে। উন্নত দেশগুলােতে নারী জাগরণের ফলে দেশের সমৃদ্ধি এসেছে, সমাজজীবন সচল ও গতিশীল হয়েছে। পুরুষের সহকর্মী হিসেবে নারীরা জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে কর্মময় জীবনের অধিকারিণী হলে দেশের সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।
মেয়েদের সচেতনতা বৃদ্ধি
পুরুষশাসিত বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় নারীরা তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ফলে একুশ শতকের দোরগােড়ায় দাঁড়িয়েও আমাদের দেশের মেয়েদের দাসিত্ব ঘােচেনি। পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণে মেয়েরা পুরুষের পাশাপাশি বাইরে এলেও এখনাে তারা পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। অধিকন্তু আমাদের দেশের নারীশিক্ষার হার খুবই কম। মেয়েদের শিক্ষিত এবং সচেতন করে তুলতে পারলে সমাজের উন্নতি সাধনে তারাও যথাযথ সূচনা রাখতে পারবে এতে কোনাে সন্দেহ নেই।
মেয়েদের শিক্ষার প্রসার
মেয়েদের শিক্ষার প্রসার ও সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীদের স্ব-মহিমায় স্বাধীন মর্যাদার অধিকারী হয়ে ওঠা অত্যাবশ্যক। এর জন্য প্রয়ােজন নারীশিক্ষার প্রসার। ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত কায়রাে সম্মেলনে নারীদের ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশসহ অংশগ্রহণকারী ১৭৯টি দেশ ১১৫ পৃষ্ঠার একটি প্রস্তাবনায় স্বাক্ষর করে। উক্ত প্রস্তাবনায় সাম্য, ন্যায়বিচার, সন্তান ধারণের প্রশ্নে নারীর ইচ্ছার প্রাধান্য, নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব আরােপ করা করা হয়েছে। আর উল্লিখিত বিষয়াবলির নিশ্চয়তা বিধানে নারীশিক্ষার কোনাে বিকল্প নেই সর্বসম্মতভাবে এমন সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়নে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ
বাংলাদেশ জাতিসংঘ ঘােষিত নারী উন্নয়ন কৌশলের সাথে একাত্মতা পােষণ করায় জাতিসংঘসহ বিশ্বব্যাংক, আইডিবি, এডিবি প্রভৃতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং দাতা দেশগুলাে বাংলাদেশে নারীশিক্ষার প্রসারে আর্থিক সাহায্য প্রদানে সম্মত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং সরকারের সদিচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে নারীশিক্ষার বিস্তারে বহুমুখী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে গৃহীত হয়েছে মেয়েদের উপবৃত্তির কর্মসূচিটি।
নারীশিক্ষায় গৃহীত উপবৃত্তি
অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর নারীরা যাতে অর্থের অভাবে শিক্ষাবিমুখ না হয়, সেজন্য গ্রাম পর্যায়ে মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা অবৈতনিক করে তাদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে এই প্রকল্প গৃহীত হয়। এ প্রকল্পে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। এই কর্মসূচির আওতায় প্রত্যেক ছাত্রীর জন্য বই কেনা বাবদ ২৫০ এবং মাসিক ৪০ টাকা হারে বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। বেতন মওকুফ ছাড়াও সরকার বই কেনা, ভর্তি। ফি, রেজিস্ট্রেশন ফি এবং পরীক্ষার ফি বাবদ ছাত্রীদেরকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে সর্বসাকুল্যে ৩৩০০ টাকা প্রদানের ব্যবস্থা নিয়েছে। ফলে গ্রামের দরিদ্র এবং অসচেতন অভিভাবকরা মেয়েদের উচ্ছ শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত হচ্ছে।
উপবৃত্তির সুফল
বাংলাদেশের মােট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। নারীশিক্ষা ব্যতীত জাতীয় উন্নয়নের কথা চিন্তাও করা যায়। তাই সরকার সামগ্রিকভাবে জাতীয় উন্নয়নের উপায় হিসেবে নারীশিক্ষা সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। উপবৃত্তির সুফল হিসেবে বাল্যবিবাহের প্রবণতাও হ্রাস পেয়েছে। আগে দরিদ্র পিতামাতারা যেখানে প্রাথমিক শিক্ষার পরপরই মেয়েদেরকে পাত্রস্থ করতে উদ্গ্রীব হয়ে পড়তাে, সেখানে আজ তারা লেখাপড়ার জন্য মেয়েদেরকে উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে। এমনকি উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে অনেক ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হচ্ছে।
উপবৃত্তি নিয়ে দুর্নীতি
গণমাধ্যমগুলােতে সাম্প্রতিককালে মাধ্যমিক পর্যায়ের উপবৃত্তির অর্থ নিয়ে দুর্নীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। একই শিক্ষার্থীকে একাধিক স্কুলে ভর্তি দেখিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের পর্যাপ্ত অভিযােগ রয়েছে। বৃত্তি প্রাপ্তির শর্ত বাস্তবায়নের ব্যাপারে স্কুলের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ন্যূনতম গুরুত্ব দেয় না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেসব দুর্নীতির সাথে এক শ্রেণির দুর্নীতিপরায়ণ শিক্ষক এবং স্কুল-কলেজ পরিচালনা কমিটির কর্তাব্যক্তিরা জড়িত। তাছাড়া । শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও দুর্নীতির উর্ধ্বে নয়।
কর্মসূচি বাস্তবায়নে করণীয়
সরকার গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সচেতন হওয়া অত্যাবশ্যক। এর জন্য সর্বপ্রথম প্রকল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সকল প্রকার ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে ওঠে দুর্নীতি মুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে। সরকারকে বৃত্তির পরিমাণ আরও কিছু বাড়াতে হবে। অন্যদিকে, অভিভাবকদেরকেও সৎ হতে হবে। শধু টাকা পাওয়ার জন্য স্কুলে না পাঠিয়ে বরং মেয়েদের কীভাবে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তােলা যায়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। মেয়েদের শিক্ষালাভের পর যাতে তাদের চাকরি হয় কিংবা স্বাবলম্বী হতে পারে এ জন্য সরকারের বিশেষ সদিচ্ছা থাকতে হবে।
উপসংহার
উপবৃত্তির ফলে অভিভাবক ও শিক্ষার্থী উভয়েরই শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে মেয়েরা শিক্ষায় অনুপ্রেরণা পাচ্ছে, মেয়েদের শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সমাজ-রাষ্ট্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতােমধ্যে নারী। শিক্ষার ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি হয়েছে যার মূলে রয়েছে উপবৃত্তি। সুতরাং নারীশিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে মেয়েদের উপবৃত্তি প্রদানের গুরুত্ব অপরিসীম।