ইসলাম ও জীবন

জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে মুসলিম খলীফাবৃন্দ

Rate this post
জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে মুসলিম খলীফাবৃন্দ

আল মনসুর (৭৫৪-৭৭৫ ) কেবল বিদ্যুৎসাহী ও জ্ঞান-বিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকই ছিলেন না, তিনি নিজেও একজন বৈজ্ঞানিক ছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান সাধনাই তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। রাজকীয় কার্য থেকে একটু অবসর পেলেই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান সাধনায় ডুবে যেতেন। তাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ তিনিই আরবের প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানী। একথা আমাদের নয়, সুপ্রসিদ্ধ ইউরোপীয় ঐতিহাসিক মিঃ বোসো বলেন, “আরব জ্যোতিবিদদের মধ্যে খলীফা আল-মনসুর সর্বপ্রথম।” তারই প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপের দ্বারা আরব বৈজ্ঞানিক ও খলীফাদের উৎসাহ এবং পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রীক, রোম, অর্য প্রভৃতি বিভিন্ন মৃত সভ্যতার বিভিন্ন প্রকারের দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতির ব্যাপকভাবে অনুবাদ শুরু হয়। ফলে বিজ্ঞান অজো পৃথিবীতে বেঁচে আছে।

ইসহাক আল-ফাজারী, ইয়াকুব ইবনে তারিক, আবু ইয়াহিয়া আল বাতরিক, নও-বখত, মাশাল্লাহ প্রমুখ বৈজ্ঞানিক মনসুরের রাজদরবারের সভাসদ ছিলেন।

৭৬৭ খৃস্টাব্দে ভারতীয় বৈজ্ঞানিক কঙ্কের সঙ্গে ইয়াকুব ইবনে তারিকের মনসুরের দরবারে সাক্ষাৎ হয়। কঙ্কের অনুপ্রেরণায় ইয়াকুব জ্যোতিবিজ্ঞানে অনুপ্রাণিত হন এবং গোলক ও কারদাজার প্রভৃতি বিজ্ঞান সম্পর্কে কয়েকটি পুস্তক প্রণয়ন করেন। ৭৭৭ খৃষ্টাব্দে গ্রন্থগুলো রচিত হয়।

আবু ইয়াহিয়া আল-বাতরিক গ্রীক বৈজ্ঞানিক টলেমির ‘টেট্রাবিবলস’ গ্রন্থ অনুবাদ করেন। তিনি তৎকালীন পণ্ডিত সমাজে অংক শাস্ত্রবিদ  হিসাবে প্রশংসা অর্জন করেন। শুধু অংক শাস্ত্রবিদ নয়, জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে তিনি পূর্বেই বিখ্যাত ছিলেন। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপরও অনেকগুলো বই লিখেন। কারণ তিনি নিজেও বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ‘টেট্রাবিবলস’ অনুবাদ করেন এবং দ্বিতীয় ফাজারী ভারতীয় বিজ্ঞান গ্রন্থ ‘সিন্দহিন্দ’ আরবীতে অনুবাদ করায় মুসলিম পণ্ডিত সমাজের বিদেশী বিজ্ঞানের দিকে বিশেষ দৃষ্টি  আকর্ষণ করে। তবে মুসলিম বৈজ্ঞানিকগণ সিন্দহিন্দের চেয়ে টেট্রাবিবলসের দিকেই বেশী ঝুকে পড়েন।

অল নও-বখত (মৃত্যু ৭৭৫ খৃষ্টাব্দ) জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এর নাম হলো ‘কিতাবুল আহকাম’। ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায় যে তার বিশেষ দক্ষতা ছিল, বাগদাদের ভিত্তি স্থাপনই এর প্রমাণ।

মাশাল্লাহ (মৃত্যু ৮১৫ কিংবা ৮২০ খৃষ্টাব্দ) জাতিতে মিসরীয়য়াহুদী বৈজ্ঞানিক ছিলেন। জাতিতে যাই হউন, প্রতিভার পূর্ণ মর্যাদা দানকারী উদার মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় তার বিজ্ঞান প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ লাভ সম্ভব হয়। বাগদাদের ভিত্তি স্থাপনের সময় বৈজ্ঞানিক ও ইঞ্জিনিয়ার আল-নও-বখতের সঙ্গে মাশাল্লাহ যে কারিগরি প্রকৌশল ও পরিকল্পনায় দক্ষতা প্রকাশ করেন, তাতেই তার প্রতি খলীফার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন। কারিগরির যন্ত্র নির্মাণ বিশেষভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত যন্ত্র নির্মাণে তার বেশ দক্ষতা ছিল। তিনি সূর্য নক্ষত্রের উষ্ণতা নির্ণয়ক অণ্ডারলব যন্ত্র নির্মাণ করেন। এই যন্ত্রের উপর নির্ভর করেই দ্বাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক রবিব-বিন-ইজরা এ সবন্ধে গ্রহ প্রণয়ন করে বিখ্যাত হন। মাশাল্লাহ বায়ু বিজ্ঞান বিষয়ক কতগুলো গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। নবম শতাব্দীর বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আল-ফারগানীও তার দ্বারা প্রভাবিত হন, তার মূল্য নিরূপক গ্রন্থাবলী আরব বৈজ্ঞানিকদের প্রথম গ্রন্থ। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক এবং অনুবাদক জোহানেস দ্য-লুনা হিসপালেনসিস তার কতগুলো গ্রন্থ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন। জিরার্ড কর্তৃকও তার গ্রন্থ অনুদিত হয়। 

পুর্বেই বলা হয়েছে খলীফা আল-মনসুরকে বর্তমান সভ্যতার জ্ঞানবিজ্ঞানের জনক বলা যেতে পারে। কারণ সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এবং তৎকালীন ভয়াবহ ধর্মীয় গোড়ামীর বিরুদ্ধে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ধার্মিক মুসলমান হয়েও মুসলমান, ইয়াহুদী, হিন্দু, খৃস্টান প্রভৃতি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অতিশয় মুক্ত উদার ও ন্যায় নিরপেক্ষ মন নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতা থেকে, বিজ্ঞানের গ্রন্থানুবাদ, গ্রন্থ সংগ্রহ, জ্ঞান আহরণ এবং বৈজ্ঞানিকদেরকে নিশ্চিন্ত-নিবিষ্ট মনে যদি জ্ঞান বিকাশের জন্যে উৎসাহিত না করতেন, তাহলে আরব শাসক ও বৈজ্ঞানিকদের এই আদর্শের জ্বলন্ত প্রেরণা আসত না এবং মনসুরের আদর্শের প্রেরণা প্লাবনে আরব বিজ্ঞান জগতে এ ধরনের নবজাগরণও অসিত না। এই মহা প্রেরণাই নতুন পথ প্রদর্শন করে, নবজাগরণের জোয়ার-তরঙ্গ সৃষ্টি করে, আরবদেরকে ক্রমশ বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারায় এমন কি পরিশেষে গ্রীক বিজ্ঞানকেও ডিঙ্গিয়ে গিয়ে, বিজ্ঞান জগতের শীর্ষ স্তরে উত্তোলন করতে সক্ষম হয়েছে।

খলীফা আল-মনসুর ভারতের সঙ্গে এমন সভ্যতা স্থাপনের প্রয়াসী হন যে, ভারতীয় বৈজ্ঞানিক কঙ্ক তাঁর নিজস্ব রাজকীয় বৈজ্ঞানিকদের সংযােগ স্থাপনপূর্বক মত ও ভাব বিনিময় করতেন। তার কেন্দ্রীয় হাসপাতালে চিকিৎসক হিসাবে একজন ভারতীয়কে প্রধান চিকিৎসক (কবিরাজ) নিযুক্ত করেন। তার নাম কি ছিল জানা যায় না। তবে আরবরা তাঁর প্রতি এত সশ্রদ্ধ ছিলেন যে, তাদের মাতৃভাষা তাকে ইবনে দহন বলে ডাকতেন।

ইবনে দহনকে খলীফা মনসুরের প্রধান চিকিৎসক নিযুক্ত করার এমনও উদ্দেশ্য হতে পারে, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের উপর আরবদের অনুবাদের দ্বারা ঔপপত্তিক জ্ঞান লাভের পরও প্রত্যক্ষ ব্যবহারিক জ্ঞান এই চিকিৎসকের মারফত আরব চিকিৎসকগণ জ্ঞাত হয়ে আরব চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করা। খলীফা মনসর ভারতে নৃপতি ও বৈজ্ঞানিকদেরকে উৎসাহিত ও প্ররোচিত করতেন, যাতে বিভিন্ন গ্রন্থসহ বৈজ্ঞানিকগণ বাগদাদে আগমন করেন। বিজ্ঞান গ্রন্থগুলো এইভাবে করায়ত্ত করে আরব বৈজ্ঞানিকদের দিয়ে অনুবাদের ব্যবস্থা করতেন। এই মহান উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে প্রধানত আল-ফাজারীই অতি উৎসাহী ছিলেন। অলি-ফাজারীর উদ্যমের ফলেই তখনকার ভারতের বিখ্যাত জ্যোতিবিজ্ঞানী কঙ্ক বা বাঙ্কায়ণ ৭৭১ খৃষ্টাব্দে ভারতের বিখ্যাত বিজ্ঞান গ্রন্থ ‘সিন্দহিন্দ’ সঙ্গে নিয়ে বাগদাদে খলীফা মনসুরের রাজসভায় উপস্থিত হয়ে খলীফার রাজ আতিথেয়তার মর্যাদা রক্ষা করেন। ‘সিন্দহিন্দ’ কঙ্ক অথবা ব্ৰহ্ম গুপ্তের সূর্য সিদ্ধান্ত নামক জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রন্থের খণ্ড সংস্করণ বিশেষ।

৭৫৭ খৃষ্টাব্দেও বৈজ্ঞানিক কঙ্ক খলীফার বিজ্ঞান সভার আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করেছিলেন। তখন বৈজ্ঞানিক ইয়াকুব ইবনে তারিকের সঙ্গে বহু উৎসাজনক আলোচনা হয়। শ্রীযুক্ত কঙ্ক তাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে বহুভাবে উৎসাহিত করেন। সিন্দহিন্দ ছাড়াও খলীফার আগ্রহে ‘আরকণ্ড’ বা ‘মন্দখাদ্যক এবং ‘আর্য্য ভট্রীয়’ প্রভৃতি বিজ্ঞানগ্রন্থও বাগদাদে আনয়ন এবং এসবের আরবী অনুবাদ করা হয়। আর্য্য ভট্রীয় গ্রন্থের লেখক আর্যভট্ট ভারতের অনন্য বৈজ্ঞানিক। তিনি পাটনার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। আর্যভট্ট পাটনার কুসুমপুরে ৪৭৬ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। আল-বেরুনী তাকে কুসুমপুরে অৰ্য্যভট্ট বলতেন।

আবু ইসহাক আল-ফাজারীর প্রচেষ্টায় ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের বারবার বাগদাদ শুভাগমন সম্ভব হয়। ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের প্রতি মুসলিম বৈজ্ঞানিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও উদ্বদ্ধ করা ছিল তার জীবনের অন্যতম ব্রত। অবশ্য এর পেছনে ছিল খলীফা মনসুরের সদিচ্ছা।

তিনি নিজেও তৎকালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে বিখ্যাত ছিলেন। জ্যোতিষশাস্ত্রে এবং দিনপঞ্জী নিরূপণ করার পদ্ধতি সম্বন্ধে তার রচিত গ্রন্থগুলো ছিল তৎকালে খুবই উচ্চস্তরের। মুসলিম বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম সমুদ্রে সূর্য ও নক্ষত্র সমূহের উচ্চতা নির্ণয় করার যন্ত্র অণ্ডারলব নির্মাণ করেন এবং অঙ্কশাস্ত্রের প্রয়োজনীয় অন্যান্য যন্ত্রপাতিও নির্মাণ করেন। ইতিপূর্বে আরব দিনপঞ্জী অবৈজ্ঞানিক ও এলোমেলো ছিল। তিনি সর্বপ্রথম আরবদের বর্ষ গণনা সুনিয়ন্ত্রিত করে দিনপঞ্জী প্রস্তুত করেন।
অলি-ফাজারীর মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র দ্বিতীয় অলি-ফাজারী খলীফা মনসুরের আদেশে সর্বপ্রথম ৭৭২-৭৭৩ খৃস্টাব্দে ‘সিন্দহিন্দের’ আরবী অনুবাদ করেন। আল-বেরুনীর মতে এর পর্বেই ৭৭০-৭৭১ খৃষ্টাব্দে ‘সিন্দহিন্দের’ আরবী অনুবাদ হয়ে গিয়েছিল। কোন বৈজ্ঞানিক এ পুস্তক  অনুবাদ করেছিলেন, তা অবশ্য তিনি উল্লেখ করেন নি।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button