বাংলা রচনা

“একজন ফেরিওয়ালার আত্মকথা” রচনা

Rate this post

 “একজন ফেরিওয়ালার আত্মকথা” রচনা

"একজন ফেরিওয়ালার আত্মকথা" রচনা
একজন ফেরিওয়ালার আত্মকথা


এই পৃথিবীতে বিচিত্র সব পেশার মানুষজনের বসবাস। আমারও একটি পেশা আছে। আমি বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র বিক্রি করি। আর তাই আমি একজন ফেরিওয়ালা। মা-বাবার দেওয়া একটা নাম অবশ্য আছে। কিন্তু সে নামে আমাকে এখন কেউ ডাকে না। সবাই আমাকে ডাকে ‘ফেরিওয়ালা’ বলে। বাড়ি-ঘর, জোত-জমি একদিন সবই আমার ছিল। কিন্তু আজ সবই গ্রাস করেছে সর্বনাশা পদ্মানদী। ঘরবাড়ি পদ্মায় তলিয়ে যাওয়ার পর পেটের দায়ে চট্টগ্রাম শহরে এসে হয়ে গেছি ফেরিওয়ালা। 

চট্টগ্রাম শহরের অলিগলি, বস্তি, আবাসিক এলাকা, পাকাসড়ক, ফুটপাতে আমাকে দেখতে পাবেন। আমি এখন হয়ে গেছি শহরের এক অপরিহার্য চরিত্র ফেরিওয়ালা।। শুরুর দিকে আমি শাকসবজি বিক্রি করতাম। শেষরাতে পাইকারি বাজার থেকে দুই খাঁচি নানা পদের সবজি নিতাম। দুই পাশে দুই খাঁচি ঝুলিয়ে কাঁধে করে হাঁটতে হাঁটতে ডাকতাম ‘হেই লালশাক, কলমিশাক, মিষ্টিকুমড়া, আলু, পটোল লাগবনি … নি-বে-ন। আমার ডাক শুনে গৃহিণীরা ছুটে এসে ভিড় করত আমার খাচির পাশে। নেড়েচেড়ে দেখত, দরদাম করত। পছন্দ হলে আড়াইশ গ্রাম, আধাকেজি, এককেজি সবজি অথবা একমুঠি পাটশাক কিংবা দুই টাকার কাঁচামরিচ কিনত। এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া, এক বস্তি থেকে অন্য বস্তি, আবাসিক এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে দুপুর নাগাদ আমার খাচির সব সবজি বেচা শেষ হয়ে যেত। বেচাকেনা খারাপ ছিল না কিন্তু লাভ হতাে কম। মালের পড়তা সবদিন ঠিক পড়ত না। তাছাড়া কাঁচামালে বাগড়া যেত বেশি। তাই দুই বছর সবজির কারবার করার পর ছেড়ে দিলাম । 

এরপর এক ভদ্রলােক বলল, কাপড়ের ব্যবসায় পড়তা ভালাে। বুঝে-শুনে একসময় কাপড়ের ব্যবসায় নেমে পড়লাম। বেডশিট, বালিশের কভার, ব্লাউজের কাপড়, ওড়না, সালােয়ার-কামিজের পিস ইত্যাদি নানারকম কাপড়ের বিরাট একটা গাঁটরি কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাজখাই গলায় ডাকতাম লাগব … বেডশিট, বালিশের কভার, থ্রি-পিস, ব্লাউজের কাপড় আছে …’। আমার ডাকশুনে বৌ-ঝি, কিশােরী-তরুণি ঘিরে ফেলত। তারপর হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে কাপড়ের রং, প্রিন্ট, কাপড়ের গুণাগুণ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করত। হাসি হাসি মুখে আমি তাদের প্রশ্নের জবাব দিতাম। বিরক্ত হলে এ ব্যবসায় করা যায় না। ফেরি করে কাপড় বিক্রির ব্যবসায় খারাপ ছিল না। কিন্তু কাঁধে করে এত বড় বােঝা নিয়ে বয়ে বেড়ানাে বেশিদিন সহ্য করতে পারিনি।

এখন আমি ঠেলাগাড়ি করে হরেকরকম জিনিসের ফেরি করি। থাকি অক্সিজেন এলাকায়। আমার বৌ বাসায় বাসায় ছুটা কাজ করে। দুই বছরের একটা ছেলে আছে। মায়ের সঙ্গেই থাকে। আমি সারাদিন গলি থেকে গলি, রাস্তা থেকে রাজপথ পেরিয়ে নানারকম জিনিস বিক্রি করি। আমার স্বল্প পুঁজির স্বাধীন ব্যবসায়। আমাকে লক্ষ রাখতে হয় মানুষের দৈনন্দিন প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের প্রতি। মানুষের প্রয়ােজন নিয়েই আমার ব্যবসায়। আমার কাছে পাওয়া যায় হাঁড়ি-পাতিল, বাসনকোসন, তৈজসপত্র, প্রসাধনী, মাথার তেল, হরেকরকম খেলনা, চুলের ফিতা, ক্লিপ, নেলপালিশ, জুতার কালি, টুথব্রাশ, ছাইদানিসহ সংসারের টুকিটাকি সবকিছু।

বাসার সামনে বা গলির মুখে গিয়ে হাঁক দিলেই বেরিয়ে আসে ঘরের বৌ, শিশু, কিশােরী, তরুণি। নিজের চোখে দেখে তারা জিনিস নির্বাচন করে। তারপর দরদাম করে। আমি কাস্টমারের মন বুঝে দাম বলি। পছন্দ হলে মানুষ দুই টাকা বেশি দিয়ে হলেও জিনিস কেনে। সংসারের দরকারি জিনিসপত্র পুরুষদের চেয়ে গৃহিণীরাই ভালাে চেনে। আমার কাছ থেকে সহজে পছন্দের জিনিসটি কিনে নেয়। সারাদিন কাটে রাস্তায়। বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় রােদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আমি হাঁটি। চট্টগ্রাম শহরের রাস্তা দিয়ে হাঁটার কি উপায় আছে? মানুষে গিজগিজ করছে। তাছাড়া বিভিন্ন জায়গায় বখরা দিয়ে আমাদের মতাে ফেরিওয়ালাদের ব্যবসায় করা দিনদিন খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। সারাদিন দশ দুয়ারে ঘুরে এক জায়গায় জিনিস বিক্রি করতে পারি। এছাড়া লাভও খুব সামান্য। বাজারের মতাে চড়াদামে আমি জিনিস বিক্রি করতে পারি না। আমাদের লাভ দিনকে দিন কমছে। অথচ চাল-ডাল-তেল-নুনের দাম দিনকে দিন বাড়ছে। তাই এখন আমাদের বাঁচাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম শহরে আমার মতাে ফেরিওয়ালার জীবন এখন হয়ে পড়েছে খুবই কষ্টের। 
অবহেলা আর দারিদ্র্যের মধ্যেই আমার বসবাস। ফেরিওয়ালা বলে কেউ আমাকে ঘৃণার চোখে দেখে, কেউ রাস্তার মানুষ বলে দূরে ঠেলে দেয়। পথই আমার জীবন, ঝুড়িভর্তি জিনিসপত্রই আমার জীবিকা। ফেরি করতে করতে একদিন পথেই আমার জীবন নিঃশেষ হয়ে যাবে। পুরানাে ভাঙা  শিশি-বােতলের মতাে একসময় হয়তাে পড়ে থাকব পথের ধুলায়। আমাদের মতাে অসহায়দের জন্য সাধারণ মানুষ ও সরকার কিছু করলে আমাদের বেঁচে থাকা কিছুটা হলেও সহজ হয়ে উঠবে। তা না হলে বর্তমান সমাজে আমাদের মতাে চুনােপুঁটিদের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button