
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবসহ গােটা বিশ্ব ছিল জাহেলিয়াতের গর্ভে নিমজ্জিত। খ্রিষ্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীর কিছু পূর্বে বা ষষ্ঠ শতাব্দীর শুরু হতে সমস্ত পৃথিবীই অজ্ঞতার চরম সীমায় পৌঁছে ছিল। আরব ভূ-খণ্ডেও এ অজ্ঞতা কুসংস্কারের সয়লাব বয়ে গিয়েছিল। আইন-কানুন নিয়ম-শৃঙ্খলা, নীতি-নৈতিকতার কোন বালাই ছিল না। ঝগড়া-বিবাদ মানুষের স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। লজ্জাহীনতা, বেহায়পনা ও অশ্লীলতায় সমাজ ভেসে গিয়েছিল। মাদকাসক্তি ও ব্যভিচারে সমাজ কলুষিত হয়ে পড়েছিল। নারীদের কোন অধিকার ছিল না। নারীদের উপর নানা অত্যাচার ও নির্যাতন চলত। ক্ষেত্রে বিশেষে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত করব দিতেও দ্বিধাবােধ করত না। একত্ববাদ অর্থাৎ এক আল্লাহর কথা ভুলে গিয়ে নানা দেব-বেদীর পূজা করত। কাবা ঘরে-ই ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করে পূজা করা হত। শাসন পদ্ধতি বা সরকার গঠনের কোন নীতি-নিয়ম ছিল না। গােত্রীয় শাসনের মধ্য দিয়ে সমাজ পরিচালিত হত। মােটকথা নীতি-নৈতিকতা, শিক্ষা-সভ্যতা, মানবতাবােধ ও ধার্মিকতার কোন পরিবেশ ছিল না। সুস্থ্য পরিবেশ ছিল না আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক জীবনেও। তবে আরবদের জীবনে কিছু প্রশংসনীয় দিক ছিল। তাদের ভাষা ছিল সমৃদ্ধ। কাব্য চর্চা, আতিথেয়তা ও নির্ভীকতায় আরবরা ছিল অসাধারণ। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবে ও তাঁর শিক্ষায় এ অমানিশার অবসান ঘটে। আর সত্য সুন্দরের নতুন আলােয় আরবসহ গােটা বিশ্ব উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
আইয়ামে জাহেলিয়া কাকে বলে
আইয়ামে জাহেলিয়ার ব্যাপ্তি
ঐতিহাসিকগণ আইয়ামে জাহেলিয়ার সময়কালের ব্যাপ্তি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। যেমনঃ
ক) কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে হযরত আদম (আ)-এর সৃষ্টিকাল হতে শুরু করে হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়কে আইয়ামে জাহেলিয়া বলা হয়। কিন্তু এ মতবাদ গ্রহণযােগ্য নয়। কারণ এই দীর্ঘ সময়ে বিপথগামী মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক নবী ও রসুলের অবসান হয়েছিল।
খ. ঐতিহাসিকের মতে- হযরত ঈসা (আ) এর ইন্তেকালের তার থেকে ইসলামের আবির্ভাব পর্যন্ত কালকে আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগ বলা হয়। এই অভিমত আংশিক গ্রহণ যােগ্য।
তবে ইতিহাস বিশ্লেষকগণ উপরিউক্ত সংজ্ঞায় আরবকে যুক্ত করার ব্যাপারে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। তারা বলেন, তদানীন্তন সময়ে দক্ষিণ আরব জ্ঞান-গরিমায় উন্নত ছিল এবং তারা সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য চেতনাসহ নানা সদগুণাবলীর অধিকারী ছিল। তবে উত্তর আরব ও মধ্য আরবের হেজাজ ও তৎসলগ্ন এলাকা ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। আন্তর্জাতিক কার্যকলাপে তারা কোন খ্যাতি অর্জন করতে পারে নাই। উক্ত অঞ্চলের পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনা করেই আইয়ামে জাহেলিয়ার সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে। তাই প্রকৃত অর্থে জাহিলী যুগ বলতে বােঝায় আরবের সেই সময় কালকে যখন সেখানে কোন নবী-রাসুলের আবির্ভাব ঘটেনি বা কোন ঐশী কিতাব নাযিল হয়নি। ফলে সমাজ-সংস্কারের অভাবে অন্যায় অবিচার ধর্মীয় কুসংস্কার ইত্যাদি নানা অনাচারে ছেয়ে গিয়েছিল। এক কথায় বলা যায়, এই অন্ধকার সময়ই জাহেলি যুগ বা Age of ignorance .
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে আরবের অবস্থা
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে আরবের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। যদিও ঐতিহাসিকগণ মনে করেন দক্ষিণ আরব জ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য অনেক উন্নত ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে আরবের অবস্থা ঠিক কেমন ছিল তা জানার জন্য আরবের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে।
ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের সামাজিক অবস্থা
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শােচনীয়। বিভিন্ন পাপাচার, ব্যভিচার, দুর্নীতি, কুসংস্কার, অনাচার, অরাজকতা, ঘৃণ্য আচার-অনুষ্ঠান ও নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডে কলুষিত হয়ে পড়েছিল সমাজ। গােত্র ভিত্তিক আরব সমাজের দুটো পৃথক শ্ৰেণী মরুবাসী বেদুঈন এবং শহরবাসী আরবদের জীবনযাত্রা প্রণালী ছিল একই সূত্রে গাঁথা। উভয় শ্রেণীর বৈবাহিক সম্পর্ক ও আচার-অনুষ্ঠান, ধ্যান-ধারণা ও রীতিনীতি ছিল প্রায় একই রকম।
মাদকাসক্তি
প্রাক-ইসলামী যুগের আরবগণ মাদকাসক্তিতে নিমজ্জিত ছিল। ঐতিহাসিক খােদা বকসের ভাষায়ঃ War, women and wine were there observing passions of the Arabs. অর্থাৎ ‘যুদ্ধ, নারী ও মদ নিয়ে তারা সর্বদা লিপ্ত থাকতাে।’ মাদকাসক্ত আরবরা যে কোন গর্হিত কাজ করতে দ্বিধা করত না।
নারীর অবস্থান
সমকালীন বিশ্বের যে কোন দেশের তুলনায় আরবের নারী জাতির অবস্থা ছিল অত্যন্ত শােচনীয়। সে যুগে নারীরা ছিল ভােগের সামগ্রী। বাজারে পণ্যের মত হস্তান্তরযােগ্য ছিল নারী। পুরুষ কর্তৃক নারীরা সর্বত্র নিগৃহীত হত। সে যুগে কন্যা সন্তানকে অপমান ও অভিশাপ মনে করে ক্ষেত্র বিশেষে জীবন্ত কবর দিতেও তারা কুষ্ঠিত হত না। অবশ্য সে যুগে গােত্রীয় সমাজে শিশু হত্যার প্রথা বিশ্বের অন্যত্রও দেখা যেত। তবে মক্কায় নারীদের মর্যাদা কিছুটা ছিল। যেমন, খাদীজা ও আবুজাহলের মা সে যুগে মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
বিবাহ
অন্ধকার যুগের বৈবাহিক প্রথায় কোন সুচিতা ছিল না। পুরুষগণ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ, ইচ্ছেমত বর্জন, অবৈধ প্রণয় এবং বহু রক্ষিতা রাখতাে। নারীগণও একই সঙ্গে একাধিক স্বামী বা বহুপতি গ্রহণ বা ব্যভিচারে লিপ্ত হত। ভাই-বােনে বিয়ে, বিমাতাকে বিয়ে করার কু-প্রথাও ছিল। পতিতাবৃত্তিও চালু ছিল।
দাস প্রথা
স্মরণাতীতকাল থেকেই আরবে দাসত্ব প্রথা প্রচলিত ছিল। দাস-দাসীদের কোন সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার ছিল না। পণ্য-দ্রব্যের মত হাটে-বাজারে কেনা-বেচা হত। দাস-দাসীকে নির্মমভাবে কাজে খাটাত ও নির্যাতন করত। দাসীকে উপপত্নী হিসেবে ব্যবহার করত। তাদের জীবন-মৃত্যু প্রভুর মর্জির উপর নির্ভর করত । বিয়ে-শাদীর অধিকারটুকুও ছিল না।
বাই অনে সুন্দর